মোল্লা জসিমউদ্দিন,
প্রতিবছর আমন কিংবা বোরো ধান চাষের সময় সেচজলের সমস্যায় ভুগে পূর্ব বর্ধমান জেলার চাষীরা। জেলা প্রশাসনের রুদ্ধশ্বাস বৈঠক বারবার হয় , মন্ত্রীবর্গ আসেন। নানান বিকল্প পদ্ধতির নির্দেশিকাজারী হয়। প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল থাকতে হয়। গত ৩ বছর জল কিনলেও মূল সমস্যা বরাবরই অন্তরালে রয়ে যায়। রাজনৈতিকগত কারনে যেভাবে বাংলার সাথে ঝাড়খন্ড রাজ্যপ্রশাসনের দূরত্ব বেড়েছে, বিশেষত ম্যাসেঞ্জার জলাধারের রঙ করা নিয়ে । তাতে সেচের জন্য জল মিলবে ঝাড়খন্ড থেকে তা না ভাবাটাই শ্রেয়। এবার আসা যাক শস্যগোলা খ্যাত পূর্ব বর্ধমানের চাষীরা কেন প্রতিবছর সেচ জলের সমস্যায় পড়েন। এত নদ - নদী সর্বপরি ডিভিসির ক্যানেলের শাখা প্রশাখাগুলি বেশিরভাগ মাঠ এলাকায় প্রবাহিত।তাহলে চাষাবাদের জন্য এই সংকট কেন? কাটোয়া মহকুমায় দীর্ঘদিন প্রশাসনিকস্তরে উচ্চ পদে থাকা এক আধিকারিক জানান - "মজে যাওয়া নদ - নদী - ক্যানেল গুলি সংস্কার করলে শুধুমাত্র সেচজল নয় আগামীদিনে শোধনপ্রকল্পে পানীয় জলের সমস্যাও মিটবে "। ওই আধিকারিকের আক্ষেপ - প্রতিবছর পূর্ব বর্ধমান জেলায় কৃষিতে ক্ষতিপূরণ বাবদ তিনশ কোটি টাকা অনুদান আসে। যদিও সেই টাকা প্রকৃত চাষীদের কাছে অনেক সময় পৌছায় না বলে অভিযোগ । পঞ্চায়েত প্রধানের ভাগীদার শংসাপত্র ও পুরানো জমির দলিল দেখিয়ে একপ্রকার লুট হয়, এইরুপ দাবি বিরোধীদের । তাই সেচ ব্যবস্থা উন্নত হলে একাধারে স্থায়ী সমস্যা যেমন মিটবে চাষাবাদে।অপরদিকে প্রতিবছর পূর্ব বর্ধমান জেলায় চাষীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ তিনশ কোটি টাকা বরাদ্দকৃত করতে হবে না রাজ্য সরকার কে। সর্বপরি পূর্ব বর্ধমান জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্লকে ভূগর্ভস্থ জলস্তর বিপদজনক হয়ে রয়েছে । তাই নদ নদী সংস্কার হলে তার সুফল আগামীদিনে পানীয়জল সংকটকে অনেকখানিই মেটাবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা । যেমন ভাগীরথী নদের জল নিয়ে কাটোয়া ও কালনায় জলশোধন প্রকল্পে লক্ষাধিক মানুষ উপকৃত। এবার আসা যাক মঙ্গলকোটে। কৃষিপ্রধান এই ব্লকে অজয় - কুনুর - ব্রাম্ভ্রনী নদী রয়েছে। বেআইনি বালিঘাটগুলির সৌজন্যে অজয় একপ্রকার সংস্কার হলেও কুনুর - ব্রাম্ভ্রনী নদীগুলি মজে গেছে। সারাবছর বর্ষার সময় টুকু ছাড়া বেশিরভাগই শুকনো থাকে। সংস্কার না হওয়ায় অল্প বর্ষাতেই উপকূলবর্তী গ্রাম গুলির একাংশ বন্যার শিকার হতে হয়। ডিভিসি কর্তৃপক্ষ কে মঙ্গলকোটে জলসরবরাহ করার জন্য এলাকার চাষীরা কর দেন। পশ্চিম মঙ্গলকোটের চারটি অঞ্চলের চাষীরা কোনকালেই জল পাননা বলে অভিযোগ। মঙ্গলকোটের অধিকাংশ ক্যানেলের লকগেট গুলি ভাঙ্গা। আউশগ্রামের পিচকুরির কাছে ডিভিসির জল ব্যাপক চুরি হয় বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য তিনবছর আগে মঙ্গলকোটের কুনুর নদী সংস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যসরকারের মধ্যে চুক্তি হয়। তৎকালীন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতীর বৈঠকও হয়েছিল রাজ্য সেচভবনে। প্রস্তাবনায় ছিল, দুর্গাপুরের ডিভিসির ব্যারেজের অদূরে থাকা সিংহম খালের নাঁচন এলাকা থেকে কুনুর নদী টি মঙ্গলকোটের কোগ্রাম অবধি প্রায় ২২ কিমি সংস্কার করা হবে। তাতে সেচ জল সমস্যা যেমন মিটবে। ঠিক তেমনি কুনুর নদীর উপর দিয়ে অজয় নদ হয়ে কাটোয়ার ভাগীরথী নদের মধ্যে এক ফেরীরুট করা হবে। তাতে যাত্রী পরিবহণ এর পাশাপাশি পণ্য পরিবহণ চলবে। কাটোয়ার শ্রীখণ্ড এলাকায় এনটিপিসির তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের সুবিধার কথাও উঠে আসে সেই কেন্দ্রীয় - রাজ্য মন্ত্রীদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে। তিন বছর কেটে গেলেও কুনুর নদী প্রকল্পের অগ্রগতি ঘটেনি। সংস্কার হলে কুনুর নদীর উপকূলে থাকা মঙ্গলকোটের পাঁচটি অঞ্চল যথা পালিগ্রাম, চাণক, লাখুরিয়া, গোতিস্টা, সদর মঙ্গলকোটের চাষীদের সেচজল নিয়ে দুশ্চিন্তার ইতি ঘটতো। ইতিহাসের পাতায় চলে যাওয়া ব্রাম্ভ্রনী নদীর সংস্কার ঘটলে মঙ্গলকোটের ঝিলু ২, নিগন, ক্ষিরোগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলের চাষীদেরও ভাবতে হতনা চাষাবাদ নিয়ে। মঙ্গলকোটের প্রায় দশের কাছাকাছি অঞ্চলে ডিভিসির ক্যানেলের শাখা ও উপশাখা প্রভাবিত। এগুলির লকগেট মেরামতি করার পাশাপাশি সংস্কার করলে সেচের জন্য আকাশ পানে চাতক পাখির মত অপেক্ষায় থাকতে হতনা। শুধুমাত্র মঙ্গলকোট নয় ভাতার, আউশগ্রাম, কাটোয়া, কেতুগ্রাম প্রভৃতি ব্লকে অনুরুপ ছবি নদ নদী ক্যানেলিগুলির। তাই রাজ্য সরকার বছর বছর তিন'শ থেকে চারশো কোটি চাষাবাদের ক্ষতিপূরণবাবদ চাষীদের অনুদান না দিয়ে নদ নদী ক্যানেল গুলি সংস্কারে স্থায়ী পরিকল্পনা নিক, তা চাইছেন সেচ বিশেষজ্ঞরা। সুশান্ত মন্ডল মঙ্গলকোটের বিডিও পদে থাকাকালীন কুনুর নদীর উপর চেক ড্যাম করার প্রস্তাবনা নেওয়া হয়েছিল। একাধারে সেচ সমস্যা মেটানোর সাথেসাথে নদীর এপার ওপারের মানুষের যোগাযোগও বাড়তো। সেই প্রস্তাবনাগুলিও বাস্তবায়ন থেকে দূর বহুদূরে রয়েছে। অবিলম্বে নদ নদী সহ ডিভিসির ক্যানেলগুলি সংস্কারের দাবিতে সরব এই জেলার চাষীরা। অনাবৃস্টি, বকেয়া বিদ্যুতের বিলে সাবমারসেবলে সংযোগ কেটে দেওয়া, প্রভৃতি সমস্যায় ফসল নষ্ট হওয়ায় বেশকিছু চাষী আত্মহননের পথও বেছে নেয়।