মোল্লা জসিমউদ্দিন
গ্রামবাংলার ক্ষমতা দখলের পঞ্চায়েত ভোট শেষ হয়েছে।এবার জেলায় জেলায় ওসি/আইসিদের একাংশ যেমন ভালো সার্ভিস দেওয়ার জন্য প্রাইজ পোস্টিং পাবেন।ঠিক তেমনি যেসব থানা এলাকায় বিরোধী দল সহ নির্দলদের বাড়বাড়ন্ত দেখা গেছে সেইসব থানার ওসিরা 'গ্যারেজ' পোস্টিং পাবেন। এইরুপ জেলাপুলিশ মহলে অন্দরের জবরখবর।যদিও এক জেলাপুলিশের পদস্থ কর্তা জানান -" যেকোন রাজ্যব্যাপী ভোটপর্ব মিটলেই পুলিশের রুটিং মাফিক বদলী হয়।কেউ অপেক্ষাকৃত ভালো পদ পান, আবার কাওকে কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত দেওয়া হয়। এখানে রাজনৈতিক কোন বিষয় ভূমিকা নেয়না।"এটা কথার কথা, তা জেলাপুলিশের প্রায় ওসি/আইসি প্রকান্তরে মেনে নিয়েছেন। ভোট মিটেছে সবে, আর পনেরোদিন পরেই জেলায় জেলায় পুলিশমহলে সম্ভাব্য বদলী ঘিরে নানান অংক ওসি/আইসিদের মধ্যে।এইসময় প্রায় পুলিশ আধিকারিক ভোটের ডিউটি সেরে লম্বা ছুটিতে যান। যারা ইতিমধ্যে নিজ নিজ থানা এলাকা বিরোধীশুন্য করেছেন মনোনয়ন পর্বেই, তাদের শাঁসালো থানায় প্রাইজ পোস্টিং।এছাড়া বিরোধীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার, ভোটের দিন বুথ দখল, গণনার দিন বিরোধী এজেন্টদের চমকানি ইত্যাদি কর্মকাণ্ড শাসকদলের মন জয় করেছেন তাদেরও গুরত্ব অনুযায়ী পোস্টিং দেওয়া হবে।আর যেসব এলাকায় মনোনয়ন পর্বে বিরোধী সহ নির্দলদের প্রভাব দেখা গেছে।সেইসাথে ভোটের দিন বিরোধীদের প্রতিরোধ, ভোটের ফলাফলে শাসকদলের প্রার্থীরা হেরেছে।সর্বোপরি শাসকদলের কর্মী/সমর্থকরা মারা পড়েছেন, সেইসব আধিকারিকদের জন্য গ্যারেজ পোস্টিং ( আইবি, ইবি,ট্রাফিক,পুলিশ লাইন) অপেক্ষা করছে।যদিও পুলিশের তরফে এই সম্ভাব্য বদলী কে রুটিং বদলী হিসাবে দাবি করা হয়েছে।ইতিমধ্যে পঞ্চায়েতের সামগ্রিক ফলাফলে পূর্ব বর্ধমান জেলা বিরোধীশুন্য জেলাপরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত হয়েছে।হাতেগোনা গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে জয় এসেছে বিজেপির।সিপিএম - কংগ্রেসের অবস্থা আরও শোচনীয়। একদা পুুুলিশমহলে তৃনমূলের মুকুল দা বর্তমানে রাজ্য বিজেপির নেতা মুকুল রায় প্রায়শ অভিযোগ সূরে বলেন "থানার ওসি / আইসিরা এখন তৃনমূলের ব্লক সভাপতির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন "। পঞ্চায়েতের দলীয় প্রতীক বিলি নিয়ে শাসকদলের দুই যুযুধান গোষ্ঠীর নেতাদের থানায় মিমাংসা করতেও দেখা গেছে।ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে বাংলায় পঞ্চায়েত শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এই সর্বপ্রথম পূর্ব বর্ধমান জেলার সমগ্র কাটোয়া মহকুমা বিরোধী শুন্য হয়।পাঁচটি ব্লক পড়ছে যেখানে।উন্নয়নের নিরিখে নাকি বিরোধীরা এখানে প্রার্থী খুঁজে পাইনি।অথচ ২০১৬ সালে বিধানসভায় কাটোয়া কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় হাজারের নিচে নিকটতম কংগ্রেস প্রার্থী কে হারিয়ে দেন।মঙ্গলকোটে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী এগারো হাজার ভোটে সিপিএম কে টপকান, কেতুগ্রামে সেখ শাহনওয়াজও হাজার দশের মার্জিন পান সিপিএম প্রার্থীর থেকে।গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বলে দিচ্ছে এইসব বিধানসভা এলাকায় বিরোধীরা যথেষ্ট শক্তিশালী। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএম এখানে পাঁচটি জেলাপরিষদ আসন, দুটি পঞ্চায়েত সমিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং কংগ্রেস - সিপিএম পনেরোর বেশি গ্রাম পঞ্চায়েত পেয়েছিল।এইধরনের ফলাফলই বলে দিচ্ছে যে, হারুক কিংবা জিতুক অন্তত মনোনয়ন পর্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিত।ব্লক অফিস কিংবা মহকুমাশাসক অফিস ঘিরে শাসকদলের বাহিনী 'ওয়ান ডে ম্যাচে' ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হলেও।এই তিনটি থানা এলাকায় ওসি/আইসিরা গত দুবছর যেভাবে বিরোধী দল সহ শাসকদলের বিক্ষুব্ধদের বিভিন্নভাবে 'টাইট' করেছে, তাতে বিরোধীশুন্য করবার আসল কারিগর পুলিশের এইসব আধিকারিকরা।এইবিধ নানান অভিযোগ বিরোধীদের।একাধারে ডাবলু আনসারীর মত অতীতে মঙ্গলকোটের মুকুটহীন সম্রাট খ্যাত সিপিএম নেতা কে দফায় দফায় গাঁজার মামলা দিয়ে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে।আবার অন্যধারে কাটোয়া বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের চরম দলীয় শত্রু তথা কাটোয়া পুরসভার তৃনমূল কাউন্সিলার জঙল সেখের পুরো পরিবার কে গাঁজার মামলা দেওয়া হয়েছে।আইনজীবীমহলের মত - 'এখন অস্ত্র মামলায় নিরপরাধ কাওকে পুলিশ মাসখানেকের বেশি রাখতে পারেনা।কিন্তু গাঁজার মামলা দিলে বছরভর রাখা যায়।তবে উচ্চ আদালতে তথ্যসংবলিত ভাবে লড়লে জামিন মেলে'। গত দুবছরে কাটোয়া মহকুমা এলাকাতে কাটোয়া - কেতুগ্রাম - মঙ্গলকোটে শতাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গাঁজা মামলা দেওয়া হয়েছে।এই সমস্ত মামলায় সির্জ দেখানো গাঁজা পুলিশ কোনদিনই হিসাব মেলাতে পারবেনা, এই ধরনের তথ্য পুলিশমহলের একাংশের।নাম প্রকাশে এক অনিচ্ছুক এইসব থানা এলাকায় ওসি পদে থাকা পুলিশ আধিকারিক বলেন - দুএকটি কেস ছাড়া বাকি সবই ফাঁসানো মামলা, কেউ উচ্চ আদালতে গেলে চরম বিপাকে পড়বে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিরা"।তাহলে আইন আদালত কে তোয়াক্কা না করে কেন পুলিশ আধিকারিকদের একাংশ এই পুলিশি সন্ত্রাস সংগঠিত করলেন? বিগত বাম জমানায় দেখা গেছে, শাঁসালো ( বালি, কয়লা) থানার পোস্টিং পেতে কিংবা দীর্ঘসময় পদে থাকতে অনেক ওসি/আইসি শাসকদলের হয়ে খাটতে 'কমরেড' সেজেছেন। ঠিক তেমনি বর্তমানে সেই ট্রাডিশান অব্যাহত পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশমহলে।বিশেষত মঙ্গলকোট, কাটোয়া থানার ওসিরা বিরোধীশুন্য এমনকি শাসকদলের বিক্ষুব্ধদের জব্দ করতে সুসংগঠিত পুলিশি সন্ত্রাস চালিয়েছেন বলে অভিযোগ। এমনকি মঙ্গলকোট বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী আটঘড়ায় মহিলাদের ঝাঁটা - জুতো কান্ডে স্থানীয় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে পুলিশসুপার কে ওসির বিরুদ্ধে জমিয়ত উলেমা হিন্দ কে দিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন।পঞ্চাশের বেশি অনুগামীদের মিথ্যা গাঁজা, অস্ত্র আইনে ফাঁসানো হয়েছে বলেও নানামহলে জানিয়েছেন তিনি।কাটোয়া পুরসভা দখলের অন্যতম কাণ্ডারি তৃনমূল কাউন্সিলার জঙ্গল সেখ কে গাঁজার মামলা দেওয়া হয়েছে।এমনকি কাউন্সিলারের স্ত্রী, ছেলেকেও গাঁজার মামলা দেওয়া হয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনে কাটোয়া বিধায়কের পথে কাঁটা না হবার জন্য।উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এই জঙ্গল সেখের জন্যই ২০১৫ সালে কংগ্রেস ছেড়ে তৃনমূলে আসেন।২০১৬ সালে মাত্র ৯৬১ টি ভোটে জিতেন এই জঙ্গল সেখের অন্তর্ঘাতে।তাই পঞ্চায়েত ভোটে কাটোয়ার দুটি ব্লক এলাকায় বিরোধীশুন্য রাখতে দলেরই কাউন্সিলার সপরিবার গাঁজার মামলা পেয়েছে বলে এলাকায় দাবি।এইরকম নানান অভিযোগ আছে কাটোয়া কেতুগ্রাম মঙ্গলকোট ওসি/আইসিদের বিরুদ্ধে।যদিও পুলিশের তরফে 'অফিসিয়াল' কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।পুলিশের অন্দরমহলের খবর - দিন পনেরো থেকে একমাসের মধ্যে পুলিশের ওসি/আইসি স্তরের আধিকারিকদের বদলীর নির্দেশিকা বের হবে।সেখানে গত দুবছর ধরে বিরোধীশুন্যর পাশাপাশি দলের বিক্ষুব্ধদের যারা টাইট করেছেন তারা প্রাইজ পোস্টিং হিসাবে শাঁসালো থানায় যাবেন।এবং যেসব এলাকায় বিরোধীদের বাড়বাড়ন্ত দেখা গেছে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন থেকে ভোট গণনা অবধি তাদের গ্যারেজ পোস্টিং অপেক্ষা করছে।যদিও পুলিশ মহলে এটা(সম্ভাব্য বদলি) কে রুটিং বদলি হিসাবে জানানো হচ্ছে।