মোল্লা জসিমউদ্দিন,
যত দিন যাচ্ছে ততই যেন হাওড়া আদালতের ঘটনায় সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে।টানা চৌদ্দ দিন সারা রাজ্যে সমস্ত আদালতে আইনজীবীদের কর্মবিরতি চলছে। এই কর্মবিরতির সময়সীমা আরও বাড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আজ অর্থাৎ বুধবার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাসে স্বতঃস্ফূর্ত মামলার ( হাওড়া কান্ড) শুনানি হয়। তাতে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে তেরো মে। উল্লেখ্য 'বার কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল' এর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী দশ মে অবধি চলবে উকিলবাবুদের কর্মবিরতি। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, যেহেতু তেরো মে পরবর্তী শুনানি রয়েছে, তাই কর্মবিরতি টা আবার বাড়বে। সুতরাং চৌদ্দ মে এর আগে রাজ্যে আদালতগুলি সচল হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাহলে ধরে নেওয়া যায় গত চব্বিশ এপ্রিল থেকে চৌদ্দ মে অবধি আইনজীবীদের কর্মবিরতি চালু থাকবে। এই কুড়ি দিনের মধ্যে চলতি লোকসভার চতুর্থ দফা এবং পঞ্চম দফা নির্বাচন ঘটেছে এবং আগামী বারো মে আবার ষষ্ঠ দফার নির্বাচন রয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীদের একাংশ সুত্রে প্রকাশ, এই কর্মবিরতি পর্ব শেষ দফা অর্থাৎ আগামী উনিশে মে অবধিও চলতে পারে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে হাওড়া কান্ডের আগে তিন দফা ভোটপর্ব মিটেছে এবং বাকি চার দফা ভোট হাওড়া কান্ডের পর। ইতিমধ্যেই বাকি চার দফার মধ্যে দু দফা হয়েছে এবং আগামীতে আরও দুদফা ভোট হবে। শেষ দফায় কলকাতা সহ শহরতলী কেন্দ্র গুলির ভোট রয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, গত চব্বিশ এপ্রিল হাওড়া জেলা আদালতে গাড়ী রাখা নিয়ে আইনজীবীদের উপর পুলিশি সন্ত্রাস কি সুপরিকল্পিত কোন ষড়যন্ত্র? কেননা সেদিন পুলিশ এতটাই বেপরোয়াভাবে আইনজীবীদের মারধর চালিয়েছে শুধু আদালত চত্বরে নয় এমনকি বিভিন্ন বিচারকের এজলাসে ঢুকে পুলিশের অতি সক্রিয়তা চোখে পড়েছে। এই ঘটনায় কুড়ির বেশি আইনজীবী আহত হন। অনেকেই সরকারি হাসপাতাল / নার্সিংহোমে ভর্তি হন। এখন প্রশ্ন সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র টা কি? মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নবান্ন তে হঠাৎই মুখ্যমন্ত্রী সদ্য নির্বাচিত বার কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এর প্রতিনিধিদের ডেকে নেন জরুরি বৈঠকে।সেই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল পন্থী আইনজীবিদের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে সক্রিয় হবার বার্তাও দেন। সেইসাথে বৈঠকে উপস্থিত এক আইনজীবির সুপারিশে বার কাউন্সিলের নির্বাচিত আইনজীবীদের দলের কোর কমিটিতে যুক্ত করার নির্দেশ সুব্রত বকসী কে দেন তৃণমূল নেত্রী ।এহেন বৈঠকে উৎফুল্ল হন তৃণমূল প্রন্থী আইনজীবীরা। এক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী এক প্রাক্তন বিচারক হাওড়া কান্ড নিয়ে মন্তব্য করেন - " লোকসভায় প্রচারের সুবিধা দিতেই হাওড়া কান্ড ঘটানো হয়েছে "। গত চব্বিশ এপ্রিলের পরেই কলকাতা হাইকোর্টের তরফে হাওড়া জেলা জজের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়। সেই রিপোর্ট অবশ্য একদিনের মধ্যেই দিয়ে দেন হাওড়া জেলাজজ। হাইকোর্টের পাঁচ বিচারপতি হাওড়া আদালতে যান পুরো ঘটনা জানতে। সেইসাথে দফায় দফায় হাইকোর্টে বার কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এর প্রতিনিধিদের সাথে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে কলকাতা হাইকোর্ট হাওড়া কান্ডে মামলা রুজু করে। এরেই মাঝে গতকাল অর্থাৎ মঙ্গলবার দুপুরে সারা রাজ্যের বিভিন্ন আদালতের একাংশ আইনজীবী সিটি সিভিল কোর্টের গেট থেকে লালবাজার হয়ে রাজভবনের গেট অবধি প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটে।আইনজীবীদের এক প্রতিনিধিদল রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। রাজ্যপাল অবশ্য বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে বিষয় টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। দেখা যাচ্ছে, হাওড়া কান্ডে চৌদ্দ দিন কেটে গেলেও সেভাবে কোন সমাধানের সুত্র বের হয়নি। নিশ্চুপ রাজ্য প্রশাসনও। কেউ কোন উচ্চবাচ্য করেনি। কর্মবিরতির মাঝে অবশ্য বীরভূম জেলা তৃনমূল সভাপতি অনুব্রত মন্ডলের হয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ',নজরবন্দি' র বিরুদ্ধে মামলা লড়তে গিয়ে আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টপাধ্যায় আইনজীবীমহলে তুমুল সমলোচিত হন। আইনজীবীদের একাংশ মনে করছে যে, 'হাওড়া কান্ড এর মাধ্যমে কর্মবিরতির অস্ত্র ব্যবহার করা হলেও হতে পারে'। একদিকে যেমন শাসক দলের হয়ে প্রচার প্রসারের ব্যাপক সুযোগ মিললো অপরদিকে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ওয়ারেন্ট তালিকা গুলি ডিসপোজাল করার নির্দেশিকা দুর্বল হল। প্রকান্তরে দাগী অপরাধীরা আদালতের আইনজীবীদের কর্মবিরতির দোহাই দিয়ে ভোটের দিন ভাল 'অফার' পাচ্ছে। ষষ্ঠ এবং সপ্তম দফার আসনগুলিতে বেশিরভাগ বুথই উত্তেজনাময়। বিশেষত কলকাতা মহানগরের লোকসভা আসনগুলিতে মস্তানদের দৌরাত্ম প্রতিবারেই দেখা যায় । ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখা গেছে, হাওড়া জেলা আদালতে এসিজেম এজলাসে ২০০ সিআরপিসি ধারায় সেদিনকার ঘটনায় অভিযোগপত্র গ্রহণ নিয়ে।তবে হাওড়া আদালতে এই মামলা কিংবা কলকাতা হাইকোর্টের স্বতঃস্ফূর্ত মামলার শুনানিপর্ব গুলি সময়সাপেক্ষ অর্থাৎ লোকসভা ভোট মিটে যাওয়ার পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের ইংগিত মিলবে। কিন্তু যারা হাওড়া কান্ডে পুলিশের অতি সক্রিয়তার পেছনে ভূমিকা নিল এবং কর্মবিরতি প্রক্রিয়া কে দীর্ঘায়িত করতে ইন্ধন দিল, তারা কি অন্তরালেই থাকবেন এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে আইনজীবীদের একাংশ মহলে।