মোল্লা জসিমউদ্দিন,
গত ২৪ এপ্রিল হাওড়া জেলা আদালতে গাড়ী রাখা নিয়ে আইনজীবীদের উপর যে পুলিশি সন্ত্রাস ঘটেছিল। তার পরিপেক্ষিতে ২৯ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে স্বতঃস্ফূর্ত মামলা রুজু হয়।এই মামলায় প্রথম পর্যায়ে অর্থ্যাৎ ৩ মে এবং ৮ মে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি ঘটে। সেইসাথে বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের ডিভিশন বেঞ্চে ১৬ মে এবং ১৭ মে পরপর দুদিন ধরে চলে এই মামলার শুনানি হয়। আজ অর্থাৎ সোমবার দুপুরে পুনরায় এই বেঞ্চে শুনানি রয়েছে।তবে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এই মামলায় রায়দান দিতেও পারে বলে হাইকোর্ট সুত্রে প্রকাশ। তবে গত শুক্রবার সন্ধের মধ্যে রাজ্য কে লিখিত আকারে অভিমত জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এডভোকেট জেনারেল কে। কেননা চলতি লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের সমস্ত পুলিশ আধিকারিকরা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের আওতায় রয়েছেন। তাই রাজ্যের অভিমত জেনে হাওড়া কান্ডে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন কে নির্দেশ দেবে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্বনাথ সম্মাদারের ডিভিশন বেঞ্চ। এই মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট মনে করছে, গত ২৪ এপ্রিল হাওড়া কান্ডে পুলিশের বিরুদ্ধে তিন থেকে চারটি বেআইনী কাজ করার মত ঘটনা ঘটেছে।সেদিনে পুলিশের বিনা অনুমতিতে আদালতের ভেতরে অনুপ্রবেশ, আইনজীবী সসর্বপরি মহিলা আইনজীবীদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ, এছাড়া টিয়ার গ্যাস চার্জ করা নিয়ে বিস্তর প্রশ্নচিহ্ন রেখেছে ডিভিশন বেঞ্চ। সেদিনের টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করা নিয়ে হাওড়া পুলিশের মালখানার সঠিক হিসাব চাওয়া হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের তরফে৷ শুনানিতে বারবার আইপিএস বিশাল গর্গ, ভিএসআর অনন্ত নাগ, ভাবনা গুপ্ত, গুলাম সারওয়ার, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিন তামাঙ, রাজশ্রী দত্তদের নাম উঠে এসেছে৷ তাই এইবিধ পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে রাজ্য অর্থাৎ নবান্ন কি অভিমত পোষণ করছে তা জেনে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন কে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্বনাথ সম্মাদার এবং বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায় নির্দেশ দিতে চান। রাজ্যের তরফে এডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত সেদিনের ঘটনায় সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত পুরোটায় বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখার দাবি তুললেও কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তা খারিজ করে জানিয়ে দেয় যে, এই মামলাটি প্রধান বিচারপতি পুলিশের অনাধিকার প্রবেশ নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত মামলার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তাঁর বাইরে যাওয়া ঠিক নয়। হাইকোর্ট প্রশাসনের তরফে আইনজীবী জয়দীপ কর অবগত করান ডিভিশন বেঞ্চ কে - সেদিন ( ২৪ এপ্রিল) হাওড়া জেলা জজ ঘটনা জেনে দ্রুত পুলিশ কমিশনার কে তলব করেছিলেন বেলা এগারো টা পনেরো মিনিটে। জেলাজজের এহেন নির্দেশ কে মান্যতা দেননি পুলিশ কমিশনার। অথচ বিকেলে এক রাজনৈতিক নেতার সাথে আদালত চত্বরে ঘুরে বেড়ান তিনি! এই ঘটনা ঘিরে গত ২৫ এপ্রিল হাওড়া পুলিশ কমিশনার ঘটনার যে তদন্ত নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই তদন্তের কোন অগ্রগতি দেখাতে পারেনি পুলিশ। এমনকি তদন্তকারী পুলিশ অফিসার আক্রান্ত মহিলা আইনজীবীর সাথে ঘটনার বিবরণ শুনবার প্রয়োজন বোধ করেন নি। এইবিধ নানান প্রশ্নচিহ্ন হাওড়া পুলিশ কে ঘিরে। ইতিমধ্যেই হাওড়া জেলা আদালত কান্ডে পুলিশি সন্ত্রাসের প্রতিবাদে গোটা রাজ্যজুড়ে আদালত গুলিতে আইনজীবীদের কর্মবিরতি চলছে। তিনটি পর্যায়ে এই কর্মবিরতি চলবে আগামী ২১ মে অর্থাৎ মঙ্গলবার পর্যন্ত। যদিও আইনজীবীমহলে জানা গেছে, যেভাবে বিগত চারটি শুনানিতে রাজ্যের এডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত সওয়াল চালাচ্ছেন, তাতে এই মামলা আরও জমে উঠেছে। সেখানে আবার কলকাতা হাইকোর্ট সহ সিভিল কোর্ট গুলিতে ২৪ মে থেকে ৯ জুন অবধি গরমের ছুটি পড়বে। তাই কর্মবিরতি আবার বাড়ার সম্ভাবনা থাকছে প্রবল।লোকসভা নির্বাচনে পুলিশ ব্যস্ত রয়েছে, তাই ঠিকমতো উত্তর মিলছে না বলেও অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে । তাই এই মামলায় দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। যদিও কলকাতা হাইকোর্ট এই ঘটনায় দ্রুত নিস্পত্তি চাইছে বলে জানা গেছে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগে এই ঘটনার কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না অনেকেই।গত শুক্রবার দুপুরে হাওড়া কান্ডের পরিপেক্ষিতে সারা রাজ্যজুড়ে আইনজীবীরা 'ব্লাক ডে' পালন করেন৷ সেদিন কাটোয়া মহকুমা আদালতে শতাধিক আইনজীবী শহরের বিভিন্ন রাস্তায় মিছিল করে প্রতিবাদ জানান৷ বিষয় টি নিয়ে যেমন কলকাতা হাইকোর্টে স্বতঃস্ফূর্ত মামলা রুজু হয়েছে। ঠিক তেমনি রাজ্যপাল সহ রাজ্য নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন আইনজীবীরা। হাওড়া কান্ডে কলকাতা হাইকোর্টের চারটি শুনানিতে যেসব প্রশ্নগুলি নিয়ে সওয়াল জবাব চলেছে। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল - গত ২৪ এপ্রিল হাওড়া জেলা আদালতে গাড়ী রাখা নিয়ে আইনজীবীদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ সহ টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করা নিয়ে কার অনুমতি নিয়েছিল পুলিশ? কেননা জেলা আদালতে সিজেএম সর্বপরি জেলাজাজের অনুমতি না নিয়ে পুলিশ কেন আদালতের ভেতর প্রবেশ করলো? তাও অফিসটাইমে, যখন সিংহভাগ বিচারকরা তাঁদের এজলাসেই থাকেন। কি এমন পরিস্থিতি যেখানে টিয়ার গ্যাস চার্জ করতে হল? তাও দুপুর দশটা থেকে সন্ধে সাতটা অর্থাৎ টানা নয় ঘন্টা কেন পুলিশের তান্ডবলীলা? পর্যাপ্ত মহিলা পুলিশ ছাড়া কেন মহিলা আইনজীবীদের উপর পুলিশ শারীরিক নিগ্রহ চালালো? এছাড়া মহিলা সিভিকরা কোন আইনী অধিকারে গ্রেপ্তার / আটক করে নিয়ে যায়? উল্লেখ্য তনুশ্রী দাস নামে এক আইনজীবী 'কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা রাস্ট্রের কর্তব্য ' বিষয়টি প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে বিশেষ কেস হিসাবে গ্রহণ করার আবেদন জমা দেয়। প্রধান বিচারপতি এই আবেদন গ্রহণ করলেও অন্য মামলাকারীরা যেকোনো মামলায় এটি কে রেফারেন্স হিসাবে নথিভুক্ত করতে পারবে না বলেও অর্ডারে উল্লেখ রেখেছেন।হাওড়া আদালতে সেদিনের ঘটনায় ছাব্বিশজন আইনজীবী আহত হয়েছিলেন। রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক ভবন ' নবান্ন' থেকে কম দুরত্বে ( ৩ কিমির কম দুরত্ব ) থাকা হাওড়া জেলা আদালতে কেন সেদিন পুলিশ এত বেপরোয়া ছিল, তা নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।এই ঘটনায় আইনজীবী এবং পুলিশের তরফে ভিডিওগ্রাফি জমা পড়েছে হাইকোর্টে। চলতি লোকসভা নির্বাচন নিয়ে যখন পুলিশ এত ব্যস্ত সেখানে হাওড়া জেলা আদালতে আইনজীবীদের উপর সুপরিকল্পিত হামলা কিভাবে চালালো পুলিশ? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কাটোয়া মহকুমা আদালতে ফৌজদারি আইনজীবী অনিন্দ চট্টরাজ সহ অনেকেই।